অধ্যাপক ড. জামিলূর রেজা চৌধুরী |
প্রকৌশলী, গবেষক, শিক্ষাবিদ, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ—এরকম নানা পরিচয়েই তিনি সুপরিচিত। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পুরকৌশল বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। কর্মজীবন শুরু করেন বুয়েটে প্রভাষক হিসেবে। পরবর্তীকালে পদোন্নতি পেয়ে অধ্যাপক হন। আশির দশক থেকে তিনি বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রায় ৯ বছর। বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য হিসেবে। http://archive.ittefaq.com.bd
Read More...
Read More...
বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করেন তিনি। বাংলাদেশের আইসিটি নীতিমালার অন্যতম একজন প্রণেতা তিনি। স্থাপত্য, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রদানকারী এই ব্যক্তিত্ব দৈনিক ইত্তেফাক-এর সাথে কথা বলেছেন দেশের আইসিটি খাতের যাত্রা, সম্ভাবনা, সঙ্কট এবং করণীয় নিয়ে। সাক্ষাত্কারটি গ্রহণ করেছেন তরিকুর রহমান সজীব
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের যাত্রা এবং বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানতে চাইলে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, '২০১৪ সালটি বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। ১৯৬৪ সালে পরমাণু শক্তি কমিশনে একটি মেইনফ্রেম কম্পিউটার স্থাপনের মাধ্যমে এই দেশে প্রথম কম্পিউটারের আগমন ঘটে। সেই হিসেবে আমাদের দেশে কম্পিউটারের যাত্রার ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে এ বছর।'
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কম্পিউটারের যাত্রার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'স্বাধীনতার পরে দেশে কম্পিউটারের ব্যবহারের শুরুটা বেশ দেরিতে হয়। যুদ্ধোত্তরকালে দেশ পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ তো ছিলই। তাছাড়া কম্পিউটার কেনার জন্য তখন বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হতো। সেটা জোগাড় করাটা তখনকার জন্য ছিল কঠিন। ওই সময়ও একটি কম্পিউটারের জন্য খরচ করতে হতো ১ কোটি টাকা। এত বিশাল অংকের বাজেট তখন একটি কম্পিউটারের জন্য বরাদ্দ করার পরিস্থিতি ছিল না। শেষে ১৯৭৯ বা ১৯৮০ সালে বুয়েটের জন্য একটি কম্পিউটার কেনা হয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বড় বড় কোম্পানিগুলোতে কম্পিউটারের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কম্পিউটারের মূল ব্যবহারই ছিল অ্যাকাউন্টিং বা ইনভেন্টরির কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট।' কম্পিউটারের পাশাপাশি দেশে ইন্টারনেটের ব্যবহারের গোড়ার দিককার কথা তুলে ধরে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, 'আশির দশক থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্ক তৈরি করে ফেলে। ইন্টারনেটের আগমন এরও পরে। ১৯৮৫ সালে আমি প্রথম কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমেইল আদান-প্রদানের অভিজ্ঞতা অর্জন করি। সে সময় আমি বুয়েটের কাছেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাবনা রাখি। পরীক্ষামূলকভাবে এটি ব্যবহারও করা হয়। তখন এর জন্য প্রয়োজন হতো ডেডিকেটেড টেলিফোন লাইন এবং মডেম, যার দাম ছিল এক লক্ষ টাকা। তবে পরীক্ষামূলকভাবে এটি ব্যবহার করা হলেও শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটি গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। এর সম্ভাবনা তখনও আসলে সবার কাছে স্পষ্ট ছিল না। তাই আর্থিক দিককে বিবেচনায় রেখেই তখন এই নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়। নব্বইয়ের দশকের গোড়াতেই সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে আমাদের যুক্ত হওয়ার সুযোগ এলেও সেটি আমরা গ্রহণ করতে পরিনি। ভিস্যাটের সাথেও শুরুর দিকে আমরা সংযুক্ত হতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ভিস্যাট উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং ভিস্যাটের মাধ্যমেই প্রথম ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত হয় বাংলাদেশ। ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে আইএসপি। শূন্য দশকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে যুক্ত হলে তুলনামূলকভাবে উচ্চগতির ইন্টারনেটের যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ।'
বর্তমানে দেশে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, 'আমাদের দেশে কিন্তু প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীই তরুণ। এই তরুণদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহ রয়েছে। তারা নতুন নতুন প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হতে চায়, তারা নতুন নতুন প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এগিয়ে যেতে চায়। তার প্রমাণ আমরা দেখছি গত এক যুগে কম্পিউটারের বিক্রির পরিমাণেই। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেও অনেকের হাতেই চলে আসছে কম্পিউটার বা ল্যাপটপ। তাছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি মানে কেবল কম্পিউটার বা ল্যাপটপই নয়। এখন স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট পিসির মতো যেসব ডিভাইস রয়েছে, সেগুলোও কিন্তু হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ছে। ইন্টারনেটের ব্যবহারকারীও বাড়ছে। তবে এর মধ্যেও ফাঁকি রয়েছে। বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ কোটি বলা হলেও এদের সবাই যে ইন্টারনেটের সব সুবিধা গ্রহণ করতে পারছে, এমনটি আমার মনে হয় না। আসলে ইন্টারনেটকে আমরা সহজলভ্য করতে পারিনি। জনগণের দোরগোড়ায় এখনও আমরা পৌঁছাতে পারিনি কম্পিউটার, ইন্টারনেটের মতো প্রযুক্তি নিয়ে। আমরা যদি দেখতে চাই যে আমাদের দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, তাহলে ইন্টারনেটের দাম কমাতে হবে এবং ইন্টারনেট যাতে সহজেই মানুষ গ্রহণ করতে পারে সে সুবিধা দিতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে তথ্যপ্রযুক্তিকে জনগণের জন্য সহজলভ্য করে তোলার বিকল্প নেই।' এর পাশাপাশি কনটেন্টে আমাদের দুর্বলতার কথাও তুলে ধরেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি বলেন, 'কনটেন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি ইন্টারনেটে যুক্ত হলাম কিন্তু আমার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, আমার স্থানীয় বিষয়গুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কনটেন্ট পেলাম না; সেটা কিন্তু ইন্টারনেটের প্রসারের পথে একটি বড় বাধা।'
সম্প্রতি সফটওয়্যার রপ্তানিতে বাংলাদেশ ভালো করছে। এ প্রসঙ্গে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, 'সফটওয়্যার রপ্তানিতে আমাদের সম্ভাবনা বরাবরই ভালো ছিল। এখন এ সুযোগ আরও বেশি। এর জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারলে সেটা নিশ্চয় দেশের রপ্তানি খাতে বড় একটি ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।' তবে এর জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, 'ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমেও এখন আমাদের দেশের তরুণরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। কিন্তু তাদের জন্য একটি বড় সমস্যা হলো স্বল্প ব্যয়ে উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ না পাওয়া। আবার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের মতো ভালো প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে না। বেসরকারিভাবে এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠলে সরকারকেই এমন সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে হবে যাতে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে উত্সাহ পায়। কম্পিউটার বিষয়ক শিক্ষা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের দেশে সর্বপ্রথম বুয়েটে কম্পিউটার বিষয়ক ডিগ্রি চালু হয়। এখন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েই কম্পিউটার নিয়ে পড়ার সুযোগ আছে। এই সুযোগ ব্যবহার করে আইটিতে দক্ষ একটি জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা সম্ভব। এরা যেমন আউটসোর্সিংয়ে ভালো করার সম্ভাবনা রাখে, তেমনি আইটি উদ্যোক্তা হিসেবেও গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রাখে।'
দেশের আইসিটি উন্নয়নে শক্তিশালী এবং যুগপোযোগী একটি আইসিটি নীতিমালার প্রয়োজন আবশ্যক বলে মনে করেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। তবে কেবল আইসিটি নীতিমালা নয়, এর সাথে কার্যকর আরও নানা পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, 'আইসিটি খাতের জন্য আইসিটি নীতিমালার বিকল্প নেই। সে কারণেই আমরা প্রথম আইসিটি নীতিমালা প্রণয়নের পরেও সেটাকে যথেষ্ট মনে করিনি। ২০০৮ সালে এই নীতিমালাকে নতুন করে লেখা হয়। তবে এর বাস্তবায়নের দিক মাথায় রেখেই এর সাথে প্রণয়ন করা হয় ভিশন, স্ট্র্যাটেজিক থিম এবং অ্যাকশন প্ল্যান। এর সবগুলোকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে আইসিটি খাত আরও দ্রুত আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে। আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। সেটি হলো—তথ্যপ্রযুক্তি অত্যন্ত গতিশীল একটি বিষয়। তাই আমাদের একটি আইসিটি নীতিমালা রয়েছে বলে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কারণ নেই। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল তথ্যপ্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে নিয়মিত বিরতিতে আইসিটি নীতিমালাকে রিভিউ করতে হবে, হালনাগাদ করতে হবে। অন্তত ছয় বছর পর পর অবশ্যই আইসিটি নীতিমালার রিভিউ হওয়া জরুরি।'
ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়ে সরকার আইসিটি খাতকে যেভাবে অগ্রাধিকার দিয়ে যাচ্ছে তাকে ইতিবাচক মনে করলেও অনেক ক্ষেত্রেই আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি জানিয়ে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, 'ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটি অত্যন্ত সময়োপযোগী। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর। আইসিটি নীতিমালাই বলি, আর ডিজিটাল বাংলাদেশই বলি—এসবের মূল লক্ষ্য হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্রুততা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। এসব লক্ষ্য থেকে আমরা এখনও অনেকটা পথ দূরে রয়েছি। এখনও পর্যন্ত সরকারের সকল মন্ত্রণালয়ে কম্পিউটারাইজেশন হয়নি। আবার সরকারি বিভিন্ন ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এসব ওয়েবসাইটের অনেকগুলোতেই কমবেশি ভুল তথ্য সন্নিবেশিত করা রয়েছে। অনেক ওয়েবসাইটই দীর্ঘদিন যাবত্ হালনাগাদ করা হয় না। এসব ক্ষেত্রে মনোযোগী হতে হবে।'
ভবিষ্যতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি বলেন, 'সার্বিকভাবে আইসিটি খাত নিয়ে বাংলাদেশ অনেক বেশি আশাবাদী হতে পারে। দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে আরও বড় আকারে জায়গা করে নেবে আইসিটি খাত। পোশাক শিল্প হয়তো আরও অনেকদিন ধরে রাজস্ব আয়ে শীর্ষস্থানে থাকবে। তবে আইসিটি দ্রুতই উঠে আসতে পারে এর পরের স্থানটিতেই। আর এর পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে তরুণরা। সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এই তরুণরা যেন আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সব সুযোগ-সুবিধা দেশে বসেই পেতে পারে। তাহলে তথ্যপ্রযুক্তিই বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে নতুন পরিচয়ে পরিচিত করে তুলতে সক্ষম হবে।' - এই লেখা টি সংগ্রহ করা হয়েছে।
এখানে ক্লিক করুন
এখানে ক্লিক করুন
No comments:
Post a Comment